আমার অনেক ব্যাচমেট আছে যাদের সমবয়সী মেয়েদের সাথে সম্পর্ক ছিলো। সম্পর্কগুলোর বেশিরভাগই বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে পারে নি। সেই ব্যাচমেটদের অনেকের সাথেই মাঝে মাঝে কথা হয়। গভীর রাতে তারা ম্যাসেজ দেয়। কেউ কেউ কলও দেয়। রাত গভীর হলে মানুষের মাঝে আবেগ বেশি কাজ করে বলেই হয়তো। যার কারণে অনেক সময় দেখা যায়, রাতের বেলা কোনো কিছু মনে করে আমরা মন খারাপ করি, কান্নাকাটি করি— দিনের বেলা ঝকঝকে রোদে সে কথা মনে হলে নিজেরাই লজ্জা পাই।
রাতের বেলা সেই ম্যাসেজগুলোতে কোনো সমাধান চাওয়ার ইচ্ছে থাকে না। থাকে শুধু কথা বলার আকুতি। কাউকে কথা শুনানোর আকুতি। শুনে মনে হয়, সবগুলো গল্পের মাঝে কেমন যেন একটা কমন থিম আছে। দুজন মানুষের মাঝে একসময় প্রণয় ছিলো। সে প্রণয়ের কোনো পরিণতি হয় নি। কেন পেলো না, কীভাবে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলো— সেটার গল্প। যেহেতু ছেলেদের কাছ থেকেই কেবল শুনি, গল্পগুলো বড্ড একপেশে হয়। সে জন্যেই আমার হয়তো মনে হয় এক্ষেত্রে ছেলেরাই যন্ত্রণা বেশি ভোগ করে।
মেয়েরা হয়তো কিছু সময় যন্ত্রণাবোধ করে। একসময় তাদের অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে যায়। সন্তান হয়। স্বামী-সন্তানকে ঘিরে তাদের আলাদা পৃথিবী তৈরী হয়ে যায়। মাঝে মাঝে তারা তাদের বিয়ের কথা, সন্তানদের কথা— প্রাক্তন ভালোবাসার মানুষদের জানিয়ে রসিকতাও করে। কোনো একসময় সেই মানুষটার জন্যে তারা জীবনটাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো, এতো পাগলামি করেছিলো— এসব কিছু তাদের কাছে তখন ছেলেমানুষী পাগলামি মনে হয়।
কিন্তু সেই পাগলামি ছেলেটার নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় লম্বা সময় ধরে। সময় তাকে সব ভুলিয়ে দেবে— এই আশা নিয়ে তার দিন কাটাতে থাকে। এই যে রাত হলেই গান শোনার বাহানায় ফোন দেয়া, কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়া, গুটিগুটি হাতের লেখার চিঠিটা বারবার পড়তে চাওয়া, শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেয়া, সকাল-দুপুর-রাতের এতো এতো স্মৃতি, এতো কথা, এতো হাসি, এতো খুনসুটি— সে ভাবে সময় তাকে এসবকিছু একদিন ভুলিয়ে দেবে। সময় কিছু হয়তো ভুলিয়ে দেয় কিন্তু নিজের সবটুকুই যদি একজনের কাছে থাকে, সময় তার কতোটুকু ভোলাতে পারে?
যেসব ছেলের কাছে আল্লাহর দ্বীন নেই, দ্বীনের বুঝ নেই, যাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হয় ভালোবাসার মানুষের সাথে আজীবন কাটিয়ে দেয়া— তারা তখন জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পায় না। বেঁচে থাকতেই চায় না। এ কারণে দেখা যায় কোনো নারীকে চাইতে গিয়ে, ভালোবাসতে গিয়ে— একটা ছেলে তার দ্বীন, দুনিয়া— সব বিসর্জন দিয়েছে, এমনকি পাগল পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে।
ইতিহাসে আমরা এমন অনেক গল্প পড়েছি। বনি-ইসরাইলের বারসিসার গল্প পড়েছি। এক মুজাহিদের গল্প পড়েছি যে এক খ্রিষ্টান নারীর প্রেমে পড়ে মুরতাদ হয়ে যায়। কুরআনের একটি আয়াত বাদে সব আয়াত ভুলে যায়। আবার এক খ্রিষ্টান ছেলের গল্পও পড়েছি যে শুধু একটা মেয়েকে পাবার জন্য পুরো শহর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)—এর কাছে তুলে দিয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটাকে তাও পায় নি। ইতিহাস ঘাটলে পুরুষদের এমন বহু পাগলামি পাওয়া যাবে। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এমন খুব কম দেখা গিয়েছে। এর মানে এই না, নারীদের মাঝে এই কষ্টগুলো নেই। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের এই কষ্টগুলো সহ্য করবার অনেক বেশি ক্ষমতা দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে আমার খুব প্রিয় একটা হাদিস আছে। হাদিসটি সহিহ বুখারিতে এসেছে। একজন দাসী ছিল যার নাম ছিলো বারিরাহ। তার স্বামীর নাম ছিলো মুগিছ। তো বারিরাহকে একসময় তার মুনিব আজাদ করে দিলো। মুক্ত বারিরাহ চাইলে তার স্বামীর সাথে থাকতে পারত আবার আলাদাও হয়ে যেতো পারতো। সে আলাদা হয়ে যাবার সিদ্ধান্তই নিলো। একজন স্বাধীন নারী হয়ে যাবার পর সে এক ক্রীতদাস স্বামীর অধীনে থাকবে— এটা সে মেনে নিতে পারছিল না।
বারিরাহর স্বামী স্ত্রীকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু মানাতেই পারলো না। মদিনার পথে বারিরাহ হেঁটে যায় আর তার পেছনে মুগিছ কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে থাকে। বারিরাহকে ফিরে আসতে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে। কান্নায় তার দাড়ি ভিজে যায়। রাসুল (সা) এ দৃশ্য দেখে আব্বাস (রা)—কে বললেন, আব্বাস! তোমার কাছে এটা চিন্তা করলে অবাক লাগে না যে, মুগিছ বারিরাহকে কতো ভালোবাসে আর অন্যদিকে বারিরাহ মুগিছকে কতো ঘৃণা করে!
মুগিছের এ অবস্থা দেখে রাসুল (সা) নিজেই বারিরাহকে বললেন, তুমি কেন ওর কাছে ফিরে যাচ্ছ না?
বারিরাহ জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাকে এমনটা করতে আদেশ দিচ্ছেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ!
রাসুল (সা) বললেন, না না! আমি তো কেবল সুপারিশ করছি মুগিছের পক্ষ থেকে।
বারিরাহ তখন বলল, তাহলে আমি যাব না। আমার ওকে কোনো দরকার নেই।
বারিরাহর কথা শুনলে মনে হতে পারে, এই যে অনেক নারী স্বামীর সাথে থাকে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে— এটা কেবল তার নিজের দরকারেই। কারণ নিজের জন্যে, নিজের সন্তানের জন্যে তার একটি অবলম্বন প্রয়োজন। যখন সে প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখন তার আর সেই অবলম্বন দরকার হয় না। এক ভাই সেদিন আফসোস করে বলেছিলেন, বেশিরভাগ পুরুষ স্বাবলম্বী হলে চিন্তা করে কীভাবে স্ত্রী-সন্তানদের আরো ভালোভাবে রাখা যায়। আর বেশিরভাগ নারী স্বাবলম্বী হলে চিন্তা করে, আমার এখন কাউকে দরকার নেই। আমি একাই চলতে পারি। হয়তো এ কারণে আমাদের শিক্ষিত স্বাবলম্বী মেয়েরা ডিভোর্সের শীর্ষে রয়েছে।
আমার লেখার এ পর্যায়ে অনেকে রেগে যেয়ে ভাবতে পারেন, আমি বড্ড একপেশে লেখা লিখছি। যদি এমনটা মনে হয়, তবে সম্ভবত ঠিকই মনে হচ্ছে। কারণ, যেহেতু কেবল ছেলেদের দুঃখ-কষ্টের গল্প লিখছি, আর আমি নিজেও একজন ছেলে— কিছুটা একপেশে তো হবেই। তাছাড়া একজন নারীকে ভালোবেসে যে পরিমাণ প্রতিভাবান পুরুষ ফিতনায় পড়েছেন, তাদের জীবন বরবাদ করেছেন— সে তুলনায় নারীরা পুরুষদের ফিতনায় পড়ে জীবন বরবাদ করেছেন— এমন সংখ্যা ইতিহাসে বিরল। আমি সাহিত্যিকদের মধ্যে কেবল একজন মহিলা ঔপন্যাসিকের নাম জানি যিনি ভালোবাসার মানুষের বিরহে আজীবন একা থেকেছেন। উনার নাম জেন অস্টেন। বিখ্যাত ইংরেজি উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’— এর লেখিকা। অন্যদিকে পুরুষ লেখক-কবিদের মধ্যে যারা আজীবন একা থেকে গেছেন, তাদের তালিকা এতো বেশি যে আমার ধারণা এ বিষয়ে স্বতন্ত্র একটা বই-ই লেখা যাবে।
একজন আরব কবির কথা বলি কেবল। নাম তার জামিল ইবনে আব্দুল্লাহ। একজনকে ভালোবাসতেন যার নাম ছিলো বুসাইনা। বুসাইনাও ভালোবাসত কবিকে। কিন্তু অন্য জায়গায় তার বিয়ে হয়ে গেলো। বুসাইনা ঠিকই বিয়ে করে ঘর-সংসার করে গেলো। কিন্তু জামিল আজীবন একাই থেকে গেলো। প্রেম-ভালোবাসার অনেক কবিতা লিখে গেলো। যার কারণে মানুষজন তাকে লম্পট ছাড়া কিছুই মনে করতো না। তার একটা কবিতা এমন-
لَقَدْ خِفْتُ أَنْ أَلْقَى الْمَنِيَّةَ بَغْتَةً
وَفِي النَّفْسِ حاجات إليك كما هيا
“ভয় হয়, হুট করে একদিন মৃত্যুর সাথে আমার দেখা হয়ে যাবে,
আর সেদিনও তোমার জন্যে প্রথমদিনের মতোই প্রেম রয়ে যাবে।”
জামিল মৃত্যশয্যায় একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, একজন লোক যে আল্লাহকে এক বলে মানে, কখনো মদ খায়নি, চুরি করেনি, ব্যভিচার করেনি, কাউকে খুন করেনি— এমন একজন সম্পর্কে আপনার কী ধারণা।
লোকটা জবাব দিলো, আশা করি, সে মুক্তি পাবে। জান্নাতে যাবে।
জামিল বলল, আমিই সেই লোক।
লোকটা অবাক হয়ে বলল, আপনি এমন কথা কীভাবে বলেন! সবাই জানে বুসাইনা নামে এক নারীর প্রেমে পড়ে বিশ বছর আপনি পাড়ি দিয়ে দিয়েছেন।
জামিল তখন বলল, আজকে আমার দুনিয়ায় শেষ দিন, আখিরাতে প্রথম দিন। আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমি যদি কখনো বুছাইনাকে খারাপ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করে থাকি, তাহলে মুহাম্মাদের শাফায়াত যেন আমার নসিবে না ঘটে।
এ কথা বলার কিছুক্ষণ পর জামিল মারা যান। ইবনে কাসির (রহ) তার ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’- গ্রন্থে জামিলের কথা উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসবিদদের মতে, নারীপ্রেমে নিজেকে বরবাদ না করলে জামিল আরবি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন হতেন। কিংবা কে জানে! হয়তো বিরহই জামিলকে কবি-সাহিত্যিক বানিয়েছে। ইবনে কাসির (রহ) যাকে কবিদের উস্তাদ বলেছেন, সেই আবু শীসের কবিতায় জামিলের অবস্থা কতোই না সুন্দরভাবে ফুটে উঠে-
وَقَفَ الْهَوَى بِي حَيْثُ أَنْتِ فَلَيْسَ لِي ... مُتَأَخَّرٌ عَنْهُ وَلَا مُتَقَدَّمُ
وأَهَنْتِنِي فَأَهَنْتُ نَفْسِي صَاغِرًا ... مَا مَنْ يَهُونُ عَلَيْكِ مِمَّنْ تكرم
“তোমাকে চাইতে চাইতে আমি এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে আছো কেবল তুমি,
আমি না সামনে যেতে পারি, না পেছাতে পারি, আমার আছো কেবল তুমি।
তুমি আমায় নীচু করে দিলে, তাই আমিও নিজেকে নামিয়েছি অনেক নীচে,
সে আর সম্মান দিয়ে কী করবে, তুমি যাকে নিজ হাতে নামিয়েছো এতো নীচে?”
জামিলের মতো এমন অনেক কবির উদাহরণ দেয়া যায়। তবে কেউ মনে করতে পারেন, একজন মানুষের প্রেমে পড়ে আজীবন কাটিয়ে দেয়া, তাও কিনা এমন প্রেম যেটা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়— আমি সেটাকে গ্লোরিফাই করছি। এমনটা যেন মনে না হয়, এ জন্যে আমি এর কিছু বিপরীত ঘটনাও উল্লেখ করি। যাদেরকে বিরহের কষ্ট দ্বীনের পথে নিয়ে এসেছে। আমাদের সমাজের ভাষায় বললে, ছ্যাঁকা খেয়ে যারা হুজুর হয়ে গেছে।
যার কথা বলব, তার নাম ফারাজদাক। আরবি সাহিত্যে যাদের পড়াশুনা আছে তারা জানেন, উনি কিংবদন্তী একজন কবি। উনি যেমন হুসাইন (রা)—এর পুত্র যাইনুল আবেদিন (রহ)—এর সম্মানে কবিতা লিখেছেন আবার অনেক উল্টাপাল্টা কবিতাও লিখেছেন। তার কবিতায় ব্যঙ্গ বেশি থাকত। আমিরদের সম্মানে কবিতা লিখে লিখে অনেক প্রভাবশালী হয়েছিলেন। সেই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নুওয়ার নামে উনার এক কাজিনকে জোর করে বিয়ে করেন। পরে একসময় তালাক দিয়ে দেন। তালাক দেয়ার পর উনার খুব অনুশোচনা হয়। উনি তার কবিতায় লেখেন—
نَدِمْتُ نَدَامَةَ الْكُسَعِيِّ لَمَّا ... غَدَتْ مِنِّي مُطَلَّقَةً نَوَارُ
وَكَانَتْ جَنَّتِي فَخَرَجْتُ مِنْهَا ... كَآدَمَ حِينَ أخرجه الضرار
“আফসোস আর দুঃখ আমার ওপর হলো সওয়ার,
যখন আলাদা হয়ে গেলো আমার কাছ থেকে নওয়ার।
ও ছিলো আমার জান্নাত, আর আমি সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম ভুলে,
ঠিক যেমন আদম বের হয়ে গিয়েছিলেন জান্নাত থেকে, ছোট্ট এক ভুলে।”
নওয়ার মারা যাবার পর হাসান বসরি (রহ) তার জানাজা পড়তে আসেন। ফারাজদাকও সেখানে হাজির হলেন। লোকজন তাদেরকে একসাথে দেখে কানাকানি শুরু করে দিলো। হাসান বসরি (রহ) ফারাজদাককে জিজ্ঞেস করলেন, সবাই কী বলছে, ফারাজদাক?
ফারাজদাক বলল, সবাই বলছে আজকের জানাজায় সবচেয়ে উত্তম মানুষ অর্থাৎ আপনি এসেছেন। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ অর্থাৎ আমি এসেছি।
হাসান বসরি (রহ) বললেন, তুমি সবচেয়ে নিকৃষ্ট নও ফারাজদাক আর আমিও সবচেয়ে উত্তম নই।
নওয়ারকে জোর করে বিয়ে করা, তারপর তালাক দেয়া, নওয়ারের মৃত্যু— ফারাজদাককে খুব কষ্ট দিচ্ছিলো। জানাজা শেষ হবার পর হাসান বসরি (রহ)— সহ সবাই যখন কবরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন ফারাজদাক আবৃত্তি করল—
أَخَافُ وَرَاءَ الْقَبْرِ إِنْ لَمْ يُعَافِنِي ... أَشَدَّ مِنَ الْقَبْرِ الْتِهَابًا وَأَضْيَقَا
إِذَا جَاءَنِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَائِدٌ ... عَنِيفٌ وَسَوَّاقٌ يسوق الفرزدقا
“আল্লাহ আমায় মাফ না করলে কবরের পর ভয় করি এমন জায়গাকে—-
যে জায়গা কবরের চেয়ে ভয়ঙ্কর, অনেক বেশি সংকীর্ণ কবরের চেয়েও।
যেদিন এমন এমন লোকেরা আসবে যারা পাষাণ, দয়া নেই যাদের একটুও,
সেদিন টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নেয়া হবে এই নিকৃষ্ট পাপী ফারাজদাককে।”
কবিতা শুনে হাসান বসরি (রহ) প্রচুর কাঁদলেন। এমনকি কান্নায় তার দাড়ি ভিজে গেলো। তিনি বললেন, ফারাজদাক, গতকালও আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতাম। কিন্তু আজ আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।
যে বিচ্ছেদ কবি জামিলকে আজীবন আল্লাহর পথ থেকে দূরে রেখেছিলো, সেই বিচ্ছেদই ফারাজদাককে আল্লাহর কাছে নিয়ে এসেছিলো। যার কারণে ফারাজদাক হাসান বসরি (রহ)—এর মতো মানুষের কাছে ঘৃণার থেকে ভালোবাসার মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।
কিংবা মারছাদ (রা) নামে একজন সাহাবির কথা আমরা হয়তো অনেকেই জানি না। যিনি একজন পতিতাকে জাহেলি যুগে ভালোবাসতেন। সে মহিলার নাম ছিল আনাক। ইসলাম গ্রহণ করার পর মারছাদ (রা) মদিনায় হিজরত করে চলে যান। রাসুল (সা)— তাকে একটা সিক্রেট মিশনে একবার মক্কায় পাঠান। মক্কায় ঘটনাক্রমে তার আনাকের সাথে দেখা হয়ে যায়। আনাক তাকে কাছে আসার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মারছাদ (রা) জিনা হারাম বলে তার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। আনাক যখন দেখে বারবার প্রলোভন দেখিয়েও কাজ হচ্ছে না, তখন মারছাদ (রা)—কে সে ধরিয়ে দিতে চায় মক্কাবাসীর কাছে। কিন্তু মারছাদ (রা) পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
মনটা কষ্টে ভেঙ্গে গেলেও মারছাদ (রা) মিশন শেষ করেই মদিনায় ফেরত আসেন। এসেই রাসুল (সা)—এর কাছে আনাককে বিয়ে করার অনুমতি চান। কিন্তু রাসুল (সা) কিছু না বলে চুপ থাকেন। আসমান থেকে এর জবাব আসে। আল্লাহ তা‘আলা কোনো পতিতা নারীকে বিয়ে করা মুসলিমদের জন্যে হারাম করে দেন। মারছাদ (রা)— আরো ভেঙ্গে পড়েন। কিন্তু তার জীবনে একটা উদ্দেশ্য ছিলো। তার পাশে আল্লাহর রাসুল (সা) ছিলেন, সাহাবারা (রা) ছিলেন— যারা তাকে সবসময় সঠিক পথে চলতে সহায়তা করেছেন।
মারছাদ (রা) পরবর্তীতে মুশরিকদের ষড়যন্ত্রে আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত বরণ করেন। আমি অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি, মারছাদ বিয়ে করেছিলেন কিনা কিংবা আনাক ইসলাম গ্রহণ করেছিলো কিনা। কিন্তু তাতে কি-বা যায় আসে! একজন মুমিনের সর্বোচ্চ যে সম্মান হতে পারে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে সেটা দান করেছিলেন। শাহাদাতের সুধা পান করিয়েছিলেন।
মারছাদ (রা) সৌভাগ্যবান তিনি আল্লাহর রাসুলকে (সা) পেয়েছিলেন। ফারাজদাকও সৌভাগ্যবান, যিনি হাসান বসরির (রহ) মতো নেককার মানুষের সানিধ্য পেয়েছিলেন। যারা তাদেরকে ভর্ৎসনা করেননি, মানুষের সাথে তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসিও করেননি, বরং তারা যেন তাদের সেই কষ্টগুলোকে পাশ কাটিয়ে আখিরাতটা গুছাতে পারেন সে জন্যে সহায়তা করেছেন। কিন্তু অনেকের ভাগ্যেই তিরষ্কার ছাড়া কিছুই জুটে না। আশেপাশের মানুষ তার অতীতের জন্যে তার ভবিষ্যতকে বরবাদ করতে একটুও কসুর করে না। আর ভুল করে যদি সেই মানুষটা সঠিক পথে চলার চেষ্টাও করে, তারা বারবার তাকে সেই অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাই তিনি যেন আমাদের সবার ভাঙ্গা হৃদয়গুলোকে জোড়া লাগিয়ে দেন। হৃদয়ের সব কষ্ট, মানুষের সব পরিহাস— সবকিছুকে একপাশে রেখে তার দ্বীনের জন্য নিজেকে কুরবান করার তৌফিক দেন।
শিহাব আহমেদ তুহিন এর টাইমলাইন থেকে
0 মন্তব্যসমূহ
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ।