সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

বকপক্ষী

টিনের চালে একটা কবুতর বসে আছে। স্বর্গীয় সাদা তার রঙ। শরতের মেঘ থেকে যেন আছড়ে পড়ছে সেই রঙ। কবুতরের পাশেই একটা কামিনী ফুলের গাছ। সেই গাছে ফুল ধরেছে। স্নিগ্ধ, ঐশ্বরিক সাদা সেই ফুল। 



হঠাৎ একটি কোকিল ডাকলো। কুহু কুহু। কামিনীসুলভ ভঙ্গীতে ডাকছে সে। কোকিলের এখন মেটিং সিজন। তাদের মিলনসুর বাজে বসন্তে। 


আজ বসন্ত। মার্চ মাস চলছে। এদেশে মার্চ বসন্তের মাস। মায়াবী এই মাসে মানুষ শান্তির জন্য যুদ্ধ লড়েছিল বাংলাদেশে। আমরা সেই বীরের জাতি।

 

বাড়ির সামনে হাসেম দিঘী। দিঘির জলে জমে থাকা কচুরীপানা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। স্বচ্ছ্ব জলরাশিতে হাসিতে ভাসছে একগুচ্ছ হংসবালা। প্রণয়লীলা শেষে নাইতে নেমেছেন লজ্জাশীলা,পতিব্রতা, বালিকাবধূগণ।

বাতাসের নির্মল প্রবাহ গাছের পাতায় মর্মর ঝংকার তুলেছে। 


এখানে সকাল হয়েছে। 

থৌরাইল বিলে নেমেছে মৎসজীবীরা। হাঁক শোনা যাচ্ছে, "ঢংলান দে! ও হো হো! " জেলেদের মাথার পাশ দিয়ে পূবের আকাশে কমলার মতো লাল প্রভাতদিবাকর উঠেছে। একঝাঁক পানকৌড়ি, ঘুঘু আর অচেনা পাখির কাফেলা উড়ে যাচ্ছে। এই ঊড়া আসলে মানুষের জন্য একটা দিক নির্দেশনা।  তাদের এই উড়ে যাওয়ার একটা অর্থবহ প্রতিক। হে মানুষের বংশধর, জমিনে ছড়িয়ে পড়ো। জীবিকা উপার্জন করো। আল্লাহর পৃথিবী দর্শন করো। চিন্তাশীল হও। জ্ঞান অর্জন করো। 


টিনের চালে কবুতরটা এখনো বসে আছে। টিনের চালের পাশে একটা বড়ই গাছ। সে গাছে একটা সূতাটুনির বাসা। এই পাখিটি খুব সম্ভবত বিরল একটি প্রজাতি। কিন্তু প্রতিবছরই মুটামুটি আমাদের বাড়িতে তারা সংসার পাতে। এই সাংসারিক পাখিটি এত সুন্দর করে ডাকে, এত চমৎকার করে খুনসুটি করে, দেখলে মন ভালো হয়ে উঠে। 



পুকুরের ঘাটে এলাকার ছেলেরা বসে। মাঝেমাঝে তারা নিজেদেরকে অতি সম্মানিত একটা ভাবে রাখতে চায়। এক সময় বন্ধুদের সাথে গল্প করতাম ঘাসে বসে,মাটিতে একগাছি মটকিলা পাতা রেখে। এখন ছেলেরা মনে করে, যারা চেয়ারে বসে তারা ছাগল! তারা নিজেদেরকে অতি সম্মানীত মানুষ ভাবে। সেক্ষেত্রে তারা যা করে সেটাও ভারি অদ্ভুত!

তারা চেহারে হেলান দেয়ার স্থানটিতে বসে। বসার স্থানে পা দেয়। মাঝেমধ্যে যদি বাস্তব ছাগলেরা এখানে উঠেও তারা অবশ্য ছেলেদের বসার স্থানটি চেটে দেয়। ছাগলের অরিজিনাল ছ্যাপের মধ্যে বিশেষ অঙ্গটি ঘসে তারা সম্ভবত একটা নিষিদ্ধ আনন্দ পায়!


থৌরাইলে মাছ ধরা শেষ। মাছের নীল ক্যারেটগুলো মাছ বোঝাই করে চলে যাবে গয়েশপুর বা কাওরাইদ। সেখানে প্রাচীন বাজার। সেই গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের আমলে গোড়া পত্তন হয়েছিল এই বাজারের। অবশ্য আরো কিছু জনশ্রুতি আছে। ভাওয়াল রাজার ছেলেরা নাকি স্থানীয় কৃষকনেতাদের সাথে যুদ্ধ করে দখলে এনেছিলেন এই জমি। আর এই গয়েশপুর নাকি এসেছে গয়েশ্বর থেকে।

তবে বাজার হিসেবে নাকি আত্মপ্রকাশ করেছে সাম্প্রতিক এক সংঘাতের সূত্র ধরে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়। 


বসন্তকালের সকালে সোনালী রোদ উঠে। আজ রোদে যে রঙ মেখেছে গায়ে, সেটা সোনালী। কামিনী গাছের পাতায় সেই রোদ ঠিকরে পড়ছে।  গাছের সামনেই আমার রুমের বারান্দা। নকশাদার সেই সোনালী আলো এসে পড়ছে আমাদের বারান্দায়। সেখানে একটা ছোট চৌকি আছে। সেখানে আমি বইটই পড়ি। আজ পড়ছি, হেক্টর গার্সিয়ার লেখা "Ikigai".

জাপানী মানুষ কীভাবে দীর্ঘায়ূ লাভ করে থাকে, সে বিষয়ক একটি বই এটি। 


এখন আর কোকিল ডাকছে না। এখন ডাকছে একটি ঘুঘুপাখি। কুরু কুরু করে সে ডাকছে। আর কিচিরমিচির করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখছে এক সহস্র ভাত-শালিক।  ঘুঘুপাখির এই প্রজাতির নাম তেল-ডুহি। সাদা রঙের ডিম ওদের। মুরগীর ডিমের মতো রঙ। 


আল আমিন পুকুরে নেমেছে। এখন সে বুদ্ধিমান। চাতুর্য আছে চলনে। বাস্তব জগতের টুকটাক হিংসা,কুটিলতা,মিলে মিশে চলা বা গড়পড়তা সাধারন গ্রামীন মানুষের মতোই হয়ে উঠেছে সে। মানসিক বিকারগ্রস্ততা কাটিয়ে কর্মঠ ও স্বতন্ত্র মানুষে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তার ক্রিকেটপ্রেম আজোও অমলিন।


গয়েশপুর বাজার সৃষ্টির যে কারণটি লোকমুখে প্রচারিত, সেটি বলা যাক। শীতকাল চলছে। চারদিকে বিবাহের মৌসুম। এই মৌসুমী আবহাওয়ায় একটা দু:খজনক ঘটনা ঘটছে। অতি রূপবতী এক মেয়ে বসেছে বিয়ের পিঁড়িতে। কিন্তু এই ঘটনায় একজন ছেলে খুবই রাগান্বিত ও উদ্বিগ্ন। 


চোখ ধাঁধানো রোদ উঠে গেছে। সবাই কর্মব্যস্ত। থৌরাইল বিলের জলসমতলে মাছেদের খাবার ছড়াচ্ছে আমিন ভাই। জীবনের মায়া সে ত্যাগ করেছিলো ফেব্রুয়ারী মাসে। কোন এক ফেব্রুয়ারীর রাতে, মরিবার হল তার সাধ। তার একটা আখের বাগান আর একটা পেপের। সেখানে কীটনাশকের যে শিশি আছে, তা তার  হাতের পাশেই। তার আত্মাহুতি দেবার শখ। স্ত্রী রূপবতী। অর্থকড়িও ঢের কম নয়। তবে এ জীবন নিশার স্বপন। তার আর শখ নেই বিশ্ব দেখার। একবার দুবাই গিয়েছিলো সে। কানে সমসময় একটা এয়ারবাড গুঁজে রাখার শখটা তখনকার। সে অবশ্য ইলেক্ট্রিকের কাজ পারে ভালো। দুবাইয়ে সে তাই করতো। মুসলিমা ভাবী লোক ভাল। সহাস্য।  আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখেন। তিনি বসেছেন পাশেই। গদগদ করে অর্ধেক শিশি গলায় ঢেলে দিলো আমিন ভাই।


ছেলেটি গফরগাঁও সরকারি কলেজের বর্তমান ভিপি। টগবগে রক্ত। বাঁধ সইলোনা তার। নদীর ওপারে তার প্রেমিকার বিয়ে হচ্ছে। "আগুন জ্বালিয়ে দেবো বাবতা গ্রামে। সব মেরে ফেলবো আমি। " ছেলের নাম জুয়েল। তরুন, রগচটা স্বভাবের। বক্তৃতা শুরু করলে চোখ মুখ লাল হয়ে যায় তার। বিয়ের আসর থেকে ছিনিয়ে আনলো মেয়ে। 

সৃষ্টি হলো বিভেদ। কাওরাইদ রেলস্টেশনে গয়েশপুর থেকে কেউ গেলে পেটানো হয়। বাজার করতে যেতে পারে না এই অঞ্চলের লোকেরা। সেই থেকে গয়েশপুরেও পত্তন হয় আরেকটি বাজারের। গয়েশপুরের বাজার। আর এই কথিত লোকটি আমার জেঠাতো ভাই।


আল আমিন পুকুর থেকে উঠেছে। পুকুরের কচুরিপানা প্রায় তোলা শেষ। জ্বাজ্জল্যমান সূর্যটি অকৃপণভাবে তাপ দিয়ে যাচ্ছে। এই মধ্যাহ্নে আমি শুনলাম খিলপাড়ার ফুফা অসুস্থ হয়েছেন। আমাকে সেখানে যেতে হবে। 


থৌরাইল বিলের পাশ ঘেঁসে সড়ক। সড়কের পাশে কড়ই গাছের সারি। রেইনট্রি কড়ই এর গাছ থেকে ঝড়া পাতার মর্মর শব্দ হচ্ছে। থৌরাইল বিলে নৌকা বাঁধা। সেটি বাঁধা আছে জলকড়ই এর শেকড়ে। আকাশের ছায়া পড়ছে থৌরাইল বিলের স্বচ্ছ জলরাশিতে। সেখানে ধুসর কচুরিপানার স্তুপের উপর থেকে উড়ে গেল বকপক্ষী আর এক ঝাক ডাহুক পাখি।

পাশেই আমিন ভাইয়ের আখ খেত। তার বিপরীত পাশে আমাদের এই মহল্লার কবরস্থান। সেখানে একটি সাদা পাথরের কবর। যেটি আগ্রহী উত্তরের মানুষদের আগমনের জন্য শান্তির  অঘোষিত মাইলফলক। এই কবস্থানের বাসিন্দা হওয়া থেকে বেঁচে ফিরেছে আমিন ভাই। 


বিষ খাওয়ার পর বাড়িতে হৈ চৈ। কিন্তু সে অস্বীকার করে। মুসলিমা ভাবী বলে যে, ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। আমি আটকাতে পারিনি। ইমার্জেন্সি রোগীকে হসপিটালে স্থানান্তর করা হলো। প্রথমে ভালকা। রাত তখন দুটা বাজে। রোগী রাখলেন না তারা। নেয়া হলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থা যায় যায়। সবাই মুটামুটি নিশ্চিত সে এযাত্রায় আর ধরাধামে ফিরবে না। অবস্থার কোন উন্নতি নেই। 

দ্বিতীয় দিন শেষ।  তৃতীয় দিনে সে সম্ভীত ফিরে পায়। সবাই বলা শুরু করে, "কি যুগ আইলো, বিষেও ভেজাল!"



বিলের উপর একটা কংক্রিটের ব্রীজ। ব্রিজের পাড়ে আসতেই আমিন ভাইয়ের সাথে দেখা। সে একটা বড় আখ আমার জন্য কাটলো। আর তার আখ খেতে আসা চোরদের সম্পর্কে একটা মজার ঘটনা বলা শুরু করলো! 


ফুফা ভালই অসুস্থ। তিনি ঘর থেকে বের হতে পারেন না। হঠাৎ তিনি এমন অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন। গতরাতে অসুধ উল্টাপাল্টা খেয়েছেন, আজ মাথা ধরেছে। ফুফা-ফুফু দুজনেই ইতালী যাবেন। ভিসাও প্রস্তুত হয়ে গেছে। এমন সময় ফুফা অসুস্থ হলেন। তারা চাইলে ইতালীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে। রাজু,রাতুল ও রানা এই তিনপুত্র আছেন ইতালীতে। আর এক পুত্র রাহাত আছে লণ্ডন। কিন্তু তারা স্বদেশ ছাড়ছেন না। 


আমিন ভাই শুরু করলো, বুঝলা, বিশেষ করে মাহফিলের দিনগুলোতে আসে চুরের দল। প্রতি মাহফিলেই অল্পবয়েসী পুলাপান এই ক্ষেতে আসে।  পরশুদিনের মাহফিল। খেতের ভিতর খচর খচর শব্দ হচ্ছে। নিচুস্বরে কথা শুনা যাচ্ছে। আমি আর আরিফ ঢুকলাম ক্ষেতে। দুইডারে পাইলাম ক্ষেতে। ধুমছে পিডাইলাম দুইজনে। কান্দাকাটি হৈ হুল্লোড় কইরা একজন লাফ দিলো বিলে। লাউয়ের মাচা ভাইঙ্গা পড়লো বিলে। রাত তখন ১১ টার বেশি। ছেলের হাতে একটা অ্যাণ্ড্রয়েড। সেট দামী। পানিত পইড়া কাব্বানি শুরু। আরিফ বাঁশঝাড়ের নিচে লাঠি নিয়া গেলো। সে টের পাইলো ছেলেটা বাঁশ ঝাড়ে উঠতে চাচ্ছে। আগারের মাথা থেকে আরো কুড়ি পচিশ লোক কেমনে জানি আইসা হাজির। 

ছেলে রাত ১১ টার পরে পুরা বিল সাঁতড়াইয়া ওইপাড়ে গিয়া উঠলো। হা হা হা।



আব্বা বাজারে গেছেন। সেখানে ঘর বানানো হবে। দোকানঘর। একটা ঘর ভাঙ্গা হচ্ছে সেখানে। সেখান থেকে স্বপ্নতরী বিদ্যানিকেতন এর বাৎসরিক ক্রীড়ানুষ্ঠান শোনা যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার জনাব একরামুল সাহেব। তিনি বেশ যত্নে বহুবছর ধরে স্কুলটিকে লালন করছেন। মহামারীর বছরটিতেও তিনি বেশ সন্তর্পনে স্কুলটি পরিচালনার ব্রত নিয়েছেন। মতিন মাস্টার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল নামে একটা ইংরেজি ভার্শনের স্কুল তিনি এই মফস্বলে দাঁড় করানোর প্রয়াস চালিয়েছেন।  

সন্ধ্যার সূর্য কোদালিয়া বিলের ওপারে রেইনট্রি গাছের আড়ালে অবস্থান করছে। আশেপাশে লাল আভা ছড়িয়ে আছে। বিলের পাড়ে অবারিত ফসলের মাঠ। এই মাঠে কত দৌড়েছি। ঘুরেছি পাখির বাসার সন্ধানে। ঘুঘুর পাখার নিচে কেটে গেছে আমাদের দুরন্ত শৈশব।  কুস্তি করেছি, ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছি। বন্ধুদের সাথে আড়ি কেটেছি। সন্ধ্যায় গলাগলি করে ফিরেছি বাড়ি। অনাহার,আতিকুল,শরিফ,এনামূলরা ছিলো এই অঞ্চলের সাথী। 

বিলপাড়ের জঙ্গলবাড়ি মাঠে আজ ফুল পিচ খেলা হচ্ছে। সাথেই একদল ছেলে মেয়ে দাড়িয়াবান্ধা খেলছে। অন্তত এই একটি দেশীয় খেলা আমাদের এলাকায় ছেলেমেয়েরা ধরে রেখেছে। অবশ্য আমি ডাংগুলি খেলাটি কীভাবে খেলতে হয়, সেটি শিখিয়েছি। 
মাগরিবের সময় হয়েছে। দিকে দিকে আজান হচ্ছে। সব পাখিরা নীড়ে ফিরছে। শুধু একটি ক্লান্ত বক এসে থমকে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের শক্ত কাঠাল গাছে।

এই গাছটির নাম কেন শক্ত কাঁঠাল তা বলা যাক। প্রকান্ড মোটা একটা পুরনো কাঁঠাল গাছ। ছাল-বাকল মরে ফোম হয়ে আছে। এই গাছ বেয়ে উঠা সাধারণ কোন ঘটনা নয়। তবে আশার কথা হলো গাছটি অত লম্বা নয়। মই দিয়ে, আতাগাছ দিয়ে বা সুপারী গাছ বেয়ে অনায়াসে এই গাছে চড়া যায়। বেশিরভাগ লোকই গাছ দিয়ে উঠে। কারণ, লুঙ্গী পড়ে সুপারী গাছে ছেঁচড়ে উঠলে কোন সময় যে তা মঞ্জিলে মকসুদ দৃশ্যমান করবে তার ঠিক নেই! তবে ওজন বেশী হলে সেটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠে। নিচে দিঘি। 

কোদালিয়া বিলের ওপারে কড়ইগাছের সারির আড়ালে সূর্য ডুবে গেছে। আঁধার নেমেছে। বিলের কাছেই আরবী বাড়ি মাদ্রাসা। সেখানে দীপ্তিমান আলোয় আল্লাহর কালামের বেশ কিছু বিদ্যার্থী মাথা ঝুঁকাচ্ছে। তারা পড়ছে। সেই পড়া এই অঞ্চলে এক অদৃশ্য পবিত্রতার চাদর দিয়ে ঘিরে রেখেছে।

আবছা অন্ধকারে রাস্তার পাশে একশো কোটি সাদা, লাল ভাঁটফুল যেন প্রত্যাগমণকারী পথচারীদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। সন্ধ্যার শেষাশেষি ঘরে এসেছি। পাখিরাও ঘরে ফিরে গেছে। শুধু এই বকপক্ষী দাঁড়িয়ে আছে একা। এই পাখিটি কী আমার হারিয়ে যাওয়া বক?
যার জন্য বিশটি বছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি!

কাঁঠাল গাছটিতে টকটকে লাল কাঁঠাল হয়। কোষগুলো কমলা রঙের। আর একটা মাঝারী ধরনের শক্ত। এই জাতের কাঁঠাল আমাদের সমগ্র বংশে পছন্দের শীর্ষে। আমি সাধারণত কাঁঠাল খেতে অপছন্দ করি। তবে, এই কাঁঠালগুলো আমার প্রিয়। এই জন্যই মূলত এই গাছটিকে শক্ত গাছ বলা হয়।

বকটির কথা মনে হতেই আমার মনটা ছ্যাঁত করে উঠলো! আজ থেকে ২০ বছর আগে। ২০০৪ সাল। আমরা একটা বিপন্ন বকের ছানাকে উদ্ধার করে আনলাম। কী সুন্দর ছিপছিপে সাদা একটা নান্দনিক বক! জীবনে প্রথমবার একটা পক্ষীর দারুন ভক্ত হয়ে উঠলাম আমি। কি যে সুন্দর এই কানাবগীটা। খাঁচা থেকে বের করে প্রায়ই আমি হাত বুলিয়ে দেই তার। ডানায় একটা রোদের গন্ধ লেগে থাকে। পাখির পাখায় এই গন্ধ থাকে।

 ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আমি একটা মহাবাজপাখি ধরে আনলাম। আলপিনের মতো সূঁচালো,ব্লেডের মতো ধারালো তার নখ। সে ছিল বিপন্ন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় সেটি নজরে আসে তাসিনের। তাসিন হলো আমার ছোট ভাই। ক্রিকেটার। গয়েশপুর বাজারে তার একটা শপ আছে। খেলাঘর। ক্রিকেট,ব্যবসা, ছবিতোলা,গান গাওয়া ইত্যাদি তার প্রিয় প্যাশন। সে অবশ্য ইদানীং সাধুবাবা সেজেছে। ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ভাত ছাড়া যে কোনো কিছুই তার খাদ্য।  কিন্তু ভাতেই তার যত অ্যালার্জি। 

"আব্বা, একটা অস্বাভাবিক বড় পাখি মসজিদের সামনে ছটফট করতেছে!" সে একটু নিচুস্বরে বললো। 
সাবধান! যাবি না! এইটা সাধারণ কোনো পাখি না। এইটা হইলো জ্বীন। এইটা মসজিদের সামনে আইবো ক্যান নইলে!
আব্বা মুটামুটি একটা ভয় ঢুকিয়ে দিলো মনে। কনকনে শীত। বাইরে যাওয়াই যায় না। এমন সময় একটা জ্বীন দেখে আসার শখ করা যাবে না। আমরা গেলাম না। 
আব্বা আবার বললেন, লোকালয়ে কোনদিন পাখিরা মরে না। কোনদিন আশেপাশে মড়া পাখি দেখছিস?
সে বললো, "না! বাবাগো!"

সকালে ফজরের নামাজের পরে মসজিদ থেকে বের হয়েছি। প্রকাণ্ড এই পাখিটি এখনো জীবিত। অতি ঠান্ডায় খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছে বোধ করি। চেষ্ঠা করেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। সোনালী চিল মারা গেলো আমার হাতের উপর। ২টা ছবি তুলা হলো। পাখা প্রকাণ্ড। তাই কেটে রাখলাম। একটা কবর খুড়লাম উত্তরের অরণ্যে। পাখিটিকে কবরে রেখে বললাম, "তোমার মতো আমাদের ও ফিরে আসতে হবে প্রভুর কাছে। বিচার দিনে তুমি আর আমাদের বকের সাথে দেখা যেন হয়!" বলতে বলতে আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। আমার বকপক্ষীটার কথা মনে হলে আমার মন খারাপ হয়। এমন ভালো কি আমি কখনো কোন নারীকে বেসেছি? বা কোন নারী বেসেছে আমাকে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ